জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি


ছেলেরা ঘরে বসে গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে আর মা তাদের জন্য চা-নাশতার ব্যবস্থা করছেন। নিজের ছেলে জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধ করছে তার মা তাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। মাতৃস্নেহের চেয়ে দেশপ্রেমকে বড় চোখে দেখে। এমন দেশপ্রেমিক দৃঢ়চেতা একজন নারী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
এমনকি তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমার আওতায় ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ থাকার পরেও এই মা তার ছেলের জন্য ক্ষমা চাননি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির কাছে, কারন তাতে তার ছেলের অসম্মান হয়। ছেলে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেছে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে গেরিলা পুত্রের মাথা নিচু করেননি জাহানারা ইমাম।
বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বইটি ব্যক্তিগত দিনলিপি আকারে লেখা, যার শুরু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ এবং সমাপ্তি সেই বছরের ১৭ ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা শহরের অবস্থা ও গেরিলা তৎপরতার বাস্তব চিত্র এতে উঠে এসেছে। বইটিতে তার সন্তান শফি ইমাম রুমী অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখা দেয় এবং তার মৃত্যুর জন্য জাহানারা ইমাম শহীদ জননী উপাধি পান। পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে এটা কেবল একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই নয়, এটা একজন মায়ের চোখে, মায়ের আবেগ মিশ্রিত মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য দলিল।
শহীদজননী জাহানারা ইমাম পেশায় ছিলেন শিক্ষক। দু সন্তানকে গড়ে তুলেছিলেন স্বাধীনচেতা করে। এই নারী নিজে যেমন দেশ নিয়ে ভাবতেন তেমনি ছেলেদেরও ভাবতে শিখিয়ে ছিলেন। ছেলেদের খুব আদর করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর কাছাকাছি যেতে পেরেছিল তারা সকলেই শহীদজননীর আদর, ভালবাসার ভাগ পেয়ে ছিল।
বইটির প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক পটভুমি ফুটে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই মায়ের সাথে দুভাইয়ের তর্ক হত যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে।এর মধ্যে রুমীর স্কলারশীপ হয়ে যায়। কিন্তু সেসময় স্কলারশীপ নিয়ে পড়তে যাওয়ার চিন্তা রুমির মাথায় একদমই ছিল না। তার চােখে ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন,দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন। একটা সময় মা তাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেন। শহীদজননী জাহানারা ইমাম তাঁর ছেলেকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেয়ার সময় একটি চমৎকার কিন্তু ভীষন বেদনাদায়ক কথা বলেছিলেন “যা তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে দিলাম”। এমন করে সে সময় বাংলাদেশের হাজার হাজার মা তার সন্তানকে দেশের জন্য কোরবানী দিয়েছেন।
রুমি যুদ্ধে চলে যায়। ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেয়। এর পরে থেকে যুদ্ধের বর্ননা শুরু হয়। সেই বর্ননায় প্রতিমুহূর্তে চোখ ভিজে উঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের যে কোন জয়ে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠে। যুদ্ধের ফাঁকে রুমি বাসায় আসে। যুদ্ধের বিবরন শোনায়। যে রুমি গ্লাসে একটু ময়লা দেখলে পানি খেত না, সেই রুমি যুদ্ধে গিয়ে পোকা খাওয়া রুটি খেত। এসব ঘটনা শুনতে শুনতে মায়ের চোখ অশ্রুতে ভরে য়ায়। এভাবে দিন কেটে যায়। তারপরে আসে সেই ২৯শে আগস্ট। সেইরাতেই রুমি, জামি, শরীফ ইমাম কে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। এছাড়া একই রাতে ধরা পড়েন আজাদ, বদি, আলতাফ মাহমুদ সহ আরও অনেকে। পরদিন জামি আর তার বাবা ফিরে এলেও রুমিরা ফেরে না। এরপর শুরু হয় এক অসহায় মায়ের আকুতি। ছেলেকে ফিরে পেতে তিনি পীরের দরবারে পর্যন্ত ধর্না দেন। কিন্তু ছেলে তার আর ফেরে না। তবু তিনি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের সন্তান ভেবে গোপনে তাদের জন্য সাহায্য পাঠাতে থাকেন। স্বাধীনতার মাত্র তিনদিন আগে তার স্বামীও মারা যায়। যুদ্ধ শেষ হয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসে। কিন্তু রুমি ফেরেনা।
এ গ্রন্থে একদিকে যেমন রয়েছে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার চিত্র, পারিবারিক সৌহার্দ্যরে বহমানতা, ইতিহাসের আকাশছোঁয়া সৌধ- তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান চিহ্নিতকরণও এ গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য দিক।
উনিশশো একাত্তর সালের মার্চ মাস থেকে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র, সাতই মার্চের উত্তাল জনতরঙ্গের আঁচড়, তেইশে মার্চ প্রতিরোধ দিবসে একটি পারিবারিক আবহের প্রেক্ষিতে গোটা জাতির অবস্থার সত্য-অবলোকন, পঁচিশে মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো নারকীয় গণহত্যা, তৎকালীন গণমাধ্যমের সত্য-অসত্য সংবাদ পরিবেশনের গল্প ছাড়াও দুইশত সত্তর পৃষ্ঠার এই বইটিতে জাহানারা ইমামের গল্পচ্ছলে বলা ইতিহাসে আমরা আমাদের পরিচয় খুঁজে পাই।
বইটিতে রুমীর জ্ঞানচর্চার ইতিহাসও আমরা জানতে পারি। ২৫ পৃষ্ঠায় জাহানার ইমাম বলেছেন, ” রুমীদের আলাপ-আলোচনার পরিধির মধ্যে পড়ে কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও-সে-তুং।”
রুমির আত্নসন্মানবোধ ফুটে উঠে সাতই মার্চের ভাষণের পর বাসায় এসে তাঁর বক্তব্যে-
“আমি কোনো দলভুক্ত নই, কোনো রাজনৈতিক দলের শ্লোগান বয়ে বেড়াই না। কিন্তু আমি সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন, মান-অপমান জ্ঞানসম্পন্ন একজন সচেতন মানুষ।”
(পৃষ্ঠা ২৩)
বইটি সম্পর্কে বিবিসি বাংলার মন্তব্য দিয়ে শেষ করছি-

No comments

Powered by Blogger.