অসমাপ্ত আত্মজীবনী-শেখ মুজিবুর রহমান


অসমাপ্ত আত্মজীবনী – শেখ মুজিবুর রহমান
শেখ মুজিবর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ কেবলমাত্র একটি আত্মজৈবনিক বই নয়, এর বহুমাত্রিক আবেদন রয়েছে।এই বইটি ১৯৩৮/৩৯ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত উপমহাদেশের (বিশেষ করে পূর্ব বাংলার) রাজনৈতিক ঘটনাবলীর এক অনবদ্য দলিল ।
একজন সাধারণ মানুষ থেকে পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির দিশারী হয়ে উঠার গল্পে ভরা এর প্রতিটা পাতা। পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে মেখ মুজিবের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ। সহজ সরল ভাষায় তিনি তার স্মৃতির রাজ্য খুলে দিয়ে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের যে ধারাবাহিক বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন, তাতে একজন পাঠক খুব সহজেই তাঁর- শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার উপাদান সমূহ অনুধাবন করতে পারবেন ।
কারাবরণের শেষে মুক্তি লাভের পর ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার হাতে এ বইয়ের ৪টি পান্ডুলিপি পৌঁছায় ।যার সামান্য ভাষাগত সম্পাদনের মাধ্যমে এ বই পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়।লেখক এ বইটি কাউকে উৎসর্গ করে যাননি ।
বইয়ের শুরুতেই লেখক তাঁর এ আত্মজীবনী লেখার কারণ উল্লেখ করেছেন । বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও বিশেষ করে প্রিয় সহধর্মিনীর কথায় তিনি এ বই লেখা শুরু করেন ।
যদিও এটি শেখ মুজিবের নিজের হাতে লেখা নিজের আত্মজীবনী, কিন্তু তিনি নিজে এ বইয়ের আসল হিরো নন, বরং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তিনি হিরোর মর্যাদা দিয়েছেন। অধিকাংশ অধ্যায় জুড়েই সোহরাওয়ার্দীর কথাই বলতে চেয়েছেন চেয়েছেন। তার রাজনৈতিক জীবনে শহীদ সাহেবের প্রভাব যে কতটা স্পষ্ট তা বইটি পড়লেই ঝকঝক হয়ে উঠবে।
সোহরাওয়ার্দী কে তিনি যেভাবে এ বইয়ে উপস্থাপন করেছেন তা উল্লেখ করলে তা ছোট একটি বইয়ের আকার ধারণ করবে।
শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীকে তার রাজনৈতিক গুরু হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিভাবে তার স্নেহ, ভালবাসায় ও নেতৃত্বে তিনি বড় হয়েছেন, কাজ করতে শিখেছেন- তা বর্ণনা করেছেন। শুরুর দিকেই তিনি লিখেছেন,
“ ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা । কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হলো। কেমন করে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।…’”
এ লাইনগুলোতে শহীদ সাহেবের প্রতি শেখ মুজিবের ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পরিচয় পাওয়া যায় ।
নিজের বংশগত পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি মধুমতী নদীর তীরে বসতী গড়া তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।তার খেলাধূলার প্রতি ঝোঁক, শৈশবের দুরন্তপনা, বাবার দলের সাথে ফুটবল খেলা, পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া, গ্লুকোমায় আক্রান্ত হওয়াসহ শৈশবের বেশ কিছু স্মৃতি তিনি এতে উল্লেখ করেছেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন । ১৯৩৮ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে তার পরিচয় হয় । বাংলার দুই বড় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেব গোপাগঞ্জে যান। সেখানেই পরিচয়।এরপর মুসলীম লীগ ও মুসলীম ছাত্রলীগের সাথে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন শেখ মুজিব।
মুসলীমলীগের পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলনে শেখ মুজিব নিজেকে একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলেন। কিন্তু তিনি আলী জিন্নাহকে নিজের নেতা মনে করতেন না, তিনি নেতা হিসেবে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে মেনে চলতেন। তবে, আলী জিন্নাহকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন।
পাকিস্তান আন্দোলনে শেখ মুজিবের অংগ্রহণ থেকে তাকে একজন সাম্প্রদায়িক মানুষ মনে হতে পারে । কিন্ত তিনি মনে প্রাণে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন । পাকিস্তান হওয়ার পর তার কর্মকান্ডই তার প্রমাণ।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে শেখ মুজিব অমানসিক পরিশ্রম করেন । তখনকার মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে তিনি মানুষকে সেবা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এখানে তিনি দুর্ভিক্ষের পারিপার্শি্বক অবস্থা বর্ণনা করেছেন।
পাকিস্তান কায়েমের পর মুসলীমলীগের রাজনীতি শেখ মুজিবকে ব্যথিত করে তুলে। মুসলীমলীগ হয়ে উঠে সমাজের উঁচু শ্রেণির এক সংগঠনে।যেখানে হিংসা ও ক্ষমতার লোভ সবাইকে অন্ধ করে দিয়েছিল।
সরকারের বিভিন্ন অন্যায়-অপকর্ম মুসলীমলীগ থেকে শেখ মুজিবের আস্থা মুছে ফেলে । পরবর্তীতে ভাষার উপর আঘাত তাকে আরও রুষ্ট করে তুলে ।
শেখ মুজিবের জীবনের দীর্ঘ সময় তাকে জেলে কাটাতে হয়েছে। এ বইও তিনি জেলে বসে লিখেছেন। জেলে বসেই তিনি একুশে ফেব্রুয়ারির ট্র্যাজেডির কথা শুনেছেন। কোন প্রকার বিচার ছাড়া তাকে মাসের পর মাস নিরাপত্তা আইনে পাকিস্তান সরকার তাকে জেলে আটকে রাখে । জেল জীবনের করুণ বর্ণনা পাওয়া যায় এর বিভিন্ন অধ্যায়ে ।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এ বইয়ের অন্যতম একটি চরিত্র ।শেখ মুজিব তাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন । এখানে তিনি মাওলানা সাহেবের পলায়ন প্রবণতার কথা উল্লেখ করেছেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গ, আওয়ামীলীগ গঠন, যুক্তফ্রন্ট গঠন, নির্বাচনের ফলাফল, যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠন, আদমজী জুট মিলের ষড়যন্ত্রমূলক দাঙ্গা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি এতে চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন

No comments

Powered by Blogger.